শুভ দৃষ্টি
-সুনির্মল বসু
জায়গাটা বেশ নির্জন, বিশাল নিম গাছের ছায়া, নদীর তীরে পালতোলা নৌকা দাঁড়িয়ে, অমল নদীর পাড়ে চাতালে বসে। একটু বাদেই নন্দিনী এলো।
আমি এসে গেছি, ছাত্রটা এত ডাল হেডেড একটু সময় লেগে গেল। অমল রুমাল পেতে দেয়, নন্দিনী পাশে এসে বসে।
-তোমার চাকরির কতদূর?
-নাহ্, কোন খবর নেই। সবাই অভিজ্ঞতা চায়, আরে বাবা, চাকরি না পেলে অভিজ্ঞতা হবে কিভাবে!
-এদিকে বাড়িতে আমার বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে,
-আমি কি করবো বলো,
-কিছু একটা তো করো,
-অতই সহজ,
-আমি কতদিন অপেক্ষায় থাকবো,
-একটু সময় দাও, দেখি,
-পাড়ার লোকেরা আমাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা বলছে,
-বলুক, আই ডোন্ট কেয়ার,
-সমাজে থাকি, একটু ভাবতে হবে বৈকি,
-তাহলে ভালোবেসেছিলে কেন?
-বলতে পারবো না, অংক করে ভালোবাসা হয় না,
-তুমি কি থামবে, না ঝগড়াই চলতে থাকবে,
দুজনেই চুপ।
-দেখো নন্দিনী, সূর্য ডুবছে। আকাশটা লাল। পাখিরা ঘরে ফিরছে।
-হ্যাঁ, একটা দিনের শেষ,
-তার মানে!
-তার মানে আরেকটা দিনের শুরু..এরপর অন্ধকার নামবে। আকাশে চাঁদ উঠবে। তারপর সকাল হবে, সূর্য উঠবে। পৃথিবীটা বড় সুন্দর, কেন ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে দিন খারাপ করবো?
-তুমি আবার চেষ্টা করো, আমি অপেক্ষায় থাকবো।
-মনে হয় স্কুলের চাকরিটা হয়ে যাবে। চলো এবার উঠি।
সপ্তাহ তিনেক পর অমল আজ খুব খুশি। মাস চারেক আগে একটা স্কুলে ও ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিল, সেখান থেকে আজ অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে দুপুরে।
বিকেলবেলা অমল নন্দিনীর বাড়ি এই শুভ সংবাদটা জানাতে ছুটলো।
কলিং বেল বাজাতেই নন্দিনী দরজা খুলে দিল, এসো।
নন্দিনী, আমার চাকরি হয়েছে। এবার আর আমাদের বিয়েতে কোন বাধা নেই। এই দেখো, আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার।
-অমল তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, আজই রাতে ফোন করে জানাবো ভেবেছিলাম, আগামী বাইশে অগ্রহায়ণ আমার বিয়ে। পাত্র বহরমপুরে ডাক্তার। এই যে বিয়ের কার্ড, তোমাকে আসতে হবে কিন্তু।
এতবড় আঘাত আসবে, স্বপ্নেও ভাবেনি অমল। সামলে নিয়ে ও কথা দিল, আসবো।
বিয়ের দিন লাল চেলি আর কপালে কুমকুম টিপে, লাল বেনারসি শাড়িতে নন্দিনীকে যে কি ভালো লাগছিল।
তপোব্রতর সঙ্গে নন্দিনীকে মানিয়েছে বেশ। ওরা ভালো থাকুক, সুখী হোক, অমল মনে মনে প্রার্থনা করলো। নন্দিনীর শ্বশুরবাড়ি অভিজাত বড়লোক। সুখী হবে নন্দিনী। যদি ওকে ভালোবেসে থাকি, তাহলে ওর সুখটুকুই তো চাওয়া উচিত।
অমল আজ নন্দিনীর জন্য মায়ের দেওয়া হার এনেছে। ওর মা চেয়েছিলেন, এটা তিনি অমলের হবু বউকে দেবেন।
নন্দিনী বললো, এসব আনতে গেলে যে!
-আমি তো কখনো কিছু তোমাকে দিতে পারিনি তাই।
নন্দিনী হারটা গলায় পরেছে। ভিড়ের মধ্যে দূর থেকে অমল চেয়ে দেখলো। মনের মধ্যে ওর তখন ঝড় চলছে। বাইরে থেকে এসব ঝড় দেখা যায় না।
কলেজ লাইফে অমল কবিতা লিখতো। এখন লেখার সময় পায় না। বেকার জীবন টিউশনিতে কেটেছে। আজ মনে হলো, জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা আজ আবার ওকে লেখা টেবিলটাকে ভালবাসতে শেখাবে।
অন্যমনস্ক অমল হঠাৎ শুনলো, শঙ্খ ধ্বনি ও উলুর শব্দ। শুভদৃষ্টি হচ্ছে ওদের। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে নন্দিনী স্বামীর দিকে চেয়ে।
অমল ভাবলো, এই শুভদৃষ্টি নন্দিনীকে পর করে দিল। আজ থেকে ওদের দ্বৈত জীবন শুরু।
অমল ভাবলো, এবার আঁধার ঘরে আমার একলা থাকা, আমি তো ওকে ঠকাইনি, নিজে ঠকে গেছি।
মনে মনে বললো, যদি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে থাকি নন্দিনী, তবে লেখায় বারবার তোমাকে আনবো। ভালোবাসা হারে না, ভালোবাসা মরে না। নদীর পাড়, শহরের নিয়ন আলো, এই সবুজ পৃথিবী তোমার আমার ভালোবাসার সাক্ষী থাকবে। এই সোনালী বিকেলগুলো কোনোদিন স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না।
অমল মনে মনে বললো, নাহ, আমার লেখায় তোমাকে আনবো না, তোমার ছায়াকে আনবো। বার বার বলবো, ভালোবাসা মরে না, ভালোবাসা মরেনি।
বিয়ের আসরে রজনীগন্ধা ফুলের একটা শুকনো ডাঁটা পড়েছিল।
অমল শুকে দেখলো, ফুলটার কি পবিত্র সুবাস।
khub sundor likhechen